গ্রাহক সেবা : Customers’ Service

 



--------------------------

গ্রাহক সেবা : Customers’ Service
*** *** ***
 
গ্রাহক সেবা


ভূমিকা
পুস্তিকা রচনার জন্য সহকর্মী ভাই-বোনদের বিশেষ আগ্র্রহ এবং আমার মনের সুপ্ত আকাঙ্খাকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে লাখো শুকরিয়া জানাই।

    অতীতে মানুষের প্রতি মানুষের গভীর অনুরাগ, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা আর মায়া-মমতার বন্ধন ছিল। কোন এলাকায় নতুন কারো আগমণ ঘটলে তাকে সাদরে গ্রহণ করা (Cordial Receptionছিল সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এটি যেন বিলুপ্তির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। নতুনভাবে অথবা অনেক দিন পর কোন এলাকায় কারো আগমণ ঘটলে তাকে সাদরে গ্রহণ করা যেন কৃষ্টি কালচার থেকে উঠে যাচ্ছে। সমাজের যে কোন স্তরেই কাউকে তার প্রাপ্য মযার্দা প্রদান না করলে বিবেকের দংশনও আজকাল অনেকেই অনুভব করেন না আর আত্মদহনেও দগ্ধ হন না। সমাজের অন্যান্য স্তরের মত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এটি মহামারীর মতই সংক্রমিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্যই যেন যেনতেনভাবে  মুনাফা অর্জন করা। এ ধারণার বশবর্তী হওয়ার কারণে উৎকর্ষ  নিয়ন্ত্রণ (Quality Controlতথা সার্বিক জনকল্যাণ থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরত্বও বেড়ে যাওয়ার  প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে নিছক বেতন ভোগী কর্মচারীদের দূরত্বের কারণে এই কর্মচারীদের কার্যক্রম হয় দায়সারা গোছের। এমন কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া একেবারেই তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার- এক কথায় দুরাশা মাত্র। পণ্য ও সেবা পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিকট থেকে উপযুক্ত মর্যাদা প্রত্যাশী অগণিত গ্রাহককূল আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই চরম ভাবে  অবমূল্যায়িত হন। এর অন্যতম কারণ হিসাবে মানুষের প্রতি মানুষের মর্যাদা প্রদানে পরান্মুখতা ও অনীহাকে  বিশেষভাবে দায়ী করা যেতে পারে। বাস্তব জীবনে  উপভোগকৃত একটা প্রত্যক্ষ ঘটনা থেকে এর একটা উদাহরণ টানার প্রয়াস পাব। উদাহরণটা হচ্ছে এই যে, কোন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এক কৃপণ ব্যক্তির পুত্রের বিয়েতে বই উপহার প্রদান করেন। উপহার  হিসাবে বই প্রদত্ত হওয়াতে উক্ত কৃপণ ব্যক্তিটির চিত্ত তুস্ট হতে পারেনি। উক্ত ব্যক্তিটি মনোপীড়ার কথা জনে জনে প্রচার করতে থাকলে এক ব্যক্তি মন্তব্য করেন যে, জ্ঞানী  লোকদের বই উপহার দিলে তারা সব চেয়ে বেশী পুলকিত হন, কিন্তু এই ব্যক্তিটি কৃপণ ও হিসাবী হওয়ার কারণে তার নিকট বই-পুস্তক মর্যাদাহীন জিনিস। কৃপণ ব্যক্তির হিসাব হচ্ছে নিম্নরূপঃ

উপহার হিসাবে প্রদত্ত বইয়ের ওজন যদি ৭৫০ গ্রাম হয় আর ১০ টাকা কেজি দরে ভাঙ্গারী/ কটকটিওয়ালার নিকট বিক্রয় করলে এর দাম দাঁড়ায় মাত্র ৭.৫০ টাকা, কিন্তু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বিয়ের উৎসবে আপ্যায়ণ খাতে এক প্লেট বিরিয়ানী বাবৎ খরচ যদি দাঁড়ায় ২০০ টাকা, তাহলে কৃপণ ব্যক্তিটির হিসাব মতে তার ক্ষতির পরিমাণ (২০০ টাকা - ৭.৫০ টাকা) = ১৯২.৫০ টাকা। অর্থাৎ মর্যাদাশীলদের মূল্যায়ণ করার যোগ্যতা যাদের নেই, তাদের হিসাব নিকাশ তো এই ধরনেরই।
যা হোক, উন্নয়ন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীসহ শহরগুলো যেখানে রুচিশীলতা আর নান্দনিক সৌন্দর্যের (Aesthetic beauty) লীলাভূমি হওয়ার কথা, সেখানে প্রতিনিয়ত নজরকাড়া বিজ্ঞাপণের ভারে শহর ও শহরতলীর রাস্তাঘাটগুলো একেবারেই সয়লাব। সত্য অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত দীনভাবাপন্ন, আর অসত্যের ছদ্মবেশ সেই জায়গাটায় রাজকীয়ভাব দখল করে নিয়েছে। তাই প্রচুর অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপণের প্রতিও সর্বসাধারণের আস্থা শূণ্যের কোঠায় নেমে আসার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। মানসম্মত সেবা পরিবেশনের ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবা পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার জবাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পক্ষ থেকে অতি ব্যস্ততার অজুহাতও উত্থাপিত হয়। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয়। অতি ব্যস্ততার মাঝে আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমেও গ্রাহককে সাদরে বরণ করা সম্ভব। আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে সালাম দেওয়া, মোবাইল ফোনে কথা বলা অবস্থায় গ্রাহকের সাথে শুধু হাত মিলানো, হাত নেড়ে অভিবাদন ও বিদায় জানানো এবং কম বয়সী বা সম-বয়সীদের ক্ষেত্রে পিঠে হাত বুলানোর মাধ্যমেও গ্রাহককে সাদরে গ্রহণ করা সম্ভব। আমাদের স্মৃতিপটে সদা জাগ্রত থাকতে হবে যে, গ্রাহক সেবা হচ্ছে একটা কলা বা কৌশল। এই কৌশল অবগত থাকলে এবং তদনুযায়ী পরিচালিত হতে পারলে অল্প আয়াশেই গ্রাহক প্রীত হতে পারেন এবং এভাবেই প্রতিষ্ঠানও অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যমে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে উপণীত হতে পারে।
 
অতীতে ব্যাংকিং ছিল অত্যন্ত ব্যস্ততাময়, নীরস, পরিশ্রমসাধ্য এবং একঘেয়েমীপূর্ণ। কাজের প্রচন্ড চাপে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক কর্মীদের প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত। ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হতো সকাল ৯:০০ টা থেকে, আর এর পরিসমাপ্তির কোন সীমা পরিসীমা থাকত না। একঘেয়েমীপূর্ণ, নীরস এবং বিমর্ষ কর্ম জীবনকে উদ্দীপনা প্রদানের মাধ্যমে সহকর্মীদের নিকট সরস ও প্রাণবন্ত করে তোলার  মানসে কর্মজীবন তথা সমগ্র জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন বিষয়ের স্মৃতিচারণ করতে হত। কর্মজীবন তথা সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ এই রোমাঞ্চকর বিষয়গুলো একত্রে সন্নিবেশিত করে একটা পুস্তিকা রচনা করার জন্য আমার সহকর্মী ভাই বোনদের পক্ষ থেকে অনুরোধের কমতি ছিল না, আর এমনটি আমিও মনস্থ করেছিলাম। এ ব্যাপারে মনের সুপ্ত বাসনাকে বাস্তব রূপদানের উদ্যোগ নেয়ার পর বিভিন্ন কারণে তা শ্লথ হয়ে যায়। কেননা পুস্তিকার মান যাতে যথাসাধ্য উন্নত হয়, সে জন্য বেশী সময় নিয়েই কাজে হাত দিতে হয়, কিন্তু এই সময়টুকু হয়ে ওঠেনি। আমার পুস্তিকা রচনার বিষয়টা আমার সহকর্মী ভাই-বোনদের অনেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন বিধায় তাঁদের কৌতুহল ছিল দূণির্বার। যা হোক পুস্তিকাটি রচিত হয়েছে আমার কর্মজীবন তথা সমগ্র জীবনে পুঞ্জিভূত অভিজ্ঞতা থেকে। ছাত্রজীবনেও কোন কোন সময় কলেজের বেতন পরিশোধসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাংকে আসা-যাওয়া করা থেকেও কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। এই গ্রীষ্ম-প্রধান দেশটার যানজটপূর্ণ রাজধানী শহরের মধ্যে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পর ঘর্মাক্ত শরীর স্বভাবতঃই একটু বিশ্রাম চায়। আর প্রচন্ড যানজটের কারণে প্রচুর সময় নষ্ট হওয়াতো আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের এক অপরিহার্য অংশ।

যা হোক এক রাতে  অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর হাত মুখ ধুয়ে লেখনীতে হাত দিলাম। তখন ছিল শরৎকাল। স্ব-গৌরবে শোভমান শারদীয় পূর্ণিমার শশধরের আলোক বিতরণ মেলা, বিশাল আকাশ জুড়ে তারকারাজির মহাসমারোহপূর্ণ সাজসজ্জা, আমার বাস ভবনের পূর্ব দিকের বৃক্ষশোভিত ও মখমলের গালিচার মত তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরবিশিষ্ট অট্টালিকা, মুক্ত বাতায়ণ হতে গোচরীভূত জোছনাস্নাত উদ্যান, আমার ঘরের বারান্দা আর নিকটতম বাড়ীর ছাদের কুসুম কাননের সুমিষ্ট সৌরভ আর মৃদুস্নিগ্ধ সমীরণের আলোড়ন আমার মনে এক আনন্দের রাজ্য রচনা করে। সবাই নিদ্রাঘোরে অচেতন; তাই পিনপতন নীরবতায় মনের অনুভূতিতে লিখিত রূপদানের প্রচেষ্টার একটা উপযুক্ত সময় এটিই বোধ হলো। লিখতে লিখতে রাতটা কোন দিক দিয়ে যে কেটে গেল তা টেরই পেলাম না। প্রভাতের মৃদুস্নিগ্ধ সমীরণ, পক্ষীকূলের সুমিষ্ট কলরব, নবাগত সূর্যের লোহিতাভ কিরণ রশ্মিতে পুলকিত সারা বিশ্বে সুমিষ্ট আলোর স্নিগ্ধ স্পর্শ, নিদ্রার আড়ষ্টতা ছেড়ে মানুষ ও পশু পক্ষীকূলের জীবনের স্পন্দিত নবজাগরণ আর আমার নিদ্রোত্থিত শিশুটার প্রাণ মাতানো হাসি, রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে।

গ্রাহক সেবা

যারা কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে জিনিসপত্র বা সেবা ক্রয় করেন, স্বাগত গ্রাহক বলা হয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মাত্রই কাঙ্খিত উদ্দেশ্য হাসিল জানা মুনাফা অর্জনে প্রয়াসী। আর এই মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হচ্ছে জিনিসপত্র বা সেবা। জিনিসপত্র বা সেবা বিক্রয় কাঙ্খিত পাঠের পাঠের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের সফলতা নিহিত। তাই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, গ্রাহক অভিপ্রায় কি? গ্রাহকের যদি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় তাহলে তা পূরণ করার জন্য প্রতিষ্ঠানের চাহিদা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। অপরপক্ষে গ্রাহকের চাহিদা যদি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা না হয় তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে বিনীত। যা গ্রাহকের চাহিদা, তা এবং হাবভাব ইত্যাদি ভালভাবে উপলদ্ধি করা হয়। গ্রাহক সেবা পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিম্মোক্ত বিষয়গুলি বিশেষভাবে বিবেচনা করা আবশ্যকঃ

১. সেবা পরিবেশনকারী কর্মীর নিজের মর্যাদা উপলদ্ধি।
২. গ্রাহকের অনুভূতির মূল্যায়ণ।
৩. সবার মযার্দা সমান নয়।
৪. মক্কেলের হিসাবের গোপনীয়তা রক্ষা করা।
৫. অপারগতার ক্ষেত্রে গ্রাহকের দাবী বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করা।
৬. অবিবেচনা প্রসূত হঠকারী এবং অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।
৭. নারী, বৃদ্ধ এবং দুর্বলদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া এবং নমনীয়তা প্রদর্শন করা।
৮. উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত জায়গায় নিয়োগ করা।
৯. গ্রাহকের সাথে হাসি মুখে কথা বলা এবং সাদরে গ্রহণ করা।
১০. শুভেচ্ছা বিনিময় এবং গ্রাহকের সুখ-দুঃখে অংশীদার হওয়া।
১১. গ্রাহকের দূর্বল এবং ক্ষুদ্র দিককে তুচ্ছ জ্ঞান না করা।
১২. প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সেবা-কর্ম সম্পর্কে অন্ততঃ ন্যূনতম ধারণা অর্জন করা।
১৩. বিপদ-আপদে অভয় বাণী প্রদান করা।
১৪. পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়া।
১৫. সময় নিষ্ঠ হওয়া।
১৬. তাড়াহুড়া পরিহার করা।
১৭. গ্রাহকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক পরিহার করা ইত্যাদি।
 
১. সেবা পরিবেশনকারী কর্মীর নিজের মর্যাদা উপলদ্ধিঃ নিজের চাকুরীটা ছোট হোক আর বড় হোকনা কেন নিজের কাজটা যে অত্যন্ত  মূল্যবান, এই বিষয়টা প্রতিটা কর্মীকে বিশেষভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। একজন নিম্নপদস্থ কর্মীর অবাঞ্চিত আচরণ ও একটা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতি গ্রস্থ করতে পারে। আবার একই ব্যক্তির সুন্দর আচরণই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বর্তমান সভ্য জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পানীয় হিসাবে চা ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি সাধারণতঃ প্রতিষ্ঠানের নিম্নপদস্থ কর্মীদের দ্বারাই পরিবেশিত হয়ে থাকে। একটু ভেবে দেখুন তো, চা পরিবেশনকালে কাপ উপচে পিরিচে যদি একটু চা পড়ে থাকে আর চা পান কালে যদি কাপ চুইয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জামায় দাগ পড়ে যায় তাহলে তার প্রতি সমাদরটিই অনাদর ও অবহেলায় পরিণত হয়ে পড়বে। যা হোক কোন দিন যদি আমরা অফিসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পাই যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাঙ্খিত মাত্রায় হয় নি তাহলে সহজেই বুঝে নিতে হয় যে, নির্ধারিত ক্লিনারের অনুপস্থিতিতে অন্য কারও দ্বারা এই কাজ সম্পাদিত হয়েছে। ব্যাংকের প্রধান গেট দ্বারা প্রবেশ করার সময় গ্রাহকসহ সবার সাক্ষাৎ হয় সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে। তার আচরণও সুন্দর হতে হবে।
 
উদাহরণঃ একদিন আমি অফিসের কাজে আমাদের শ্যামলী শাখায় গিয়েছিলাম, মেইন কলাপসিবল গেইট ছিল তালাবন্ধ। গেটে নক করে সিকিউরিটি গার্ডকে আমার পরিচয় দিলাম। আমি আরও জানালাম যে, ম্যানেজার ও সেকেন্ড অফিসার দু’জনই আমার পরিচিত। সিকিউরিটি গার্ড সেকেন্ড অফিসারের অনুমতি নিয়ে এসে আমাকে প্রবেশ করতে দেন, আর বিনীতভাবে বলেন, “স্যার মনে কোন কষ্ট নেবেন না, ইদানিং অনেক ধরনের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হচ্ছে, বিধায় আমাদেরকে খুব সাবধানে অপরিচিতদেরকে ঢুকতে দিতে বলা হয়েছে। আমি নিয়ম মত দায়িত্ব পালন করার কারণে তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
মন্তব্যঃ 
 (ক) প্রথমে আমি ছিলাম আগন্তুক, সুতরাং আমার পরিচয় জানতে চাওয়া উক্ত সিকিউরিটি গার্ডের পেশাগত দায়িত্ব ছিল।
 (খ) পরিচয় দেওয়ার পর তা যাচাই করা তার কর্তব্য ছিল।
 (গ) পরিচয়ের সত্যতা যাচাই এর পর আমাকে স্ব-সম্মানে প্রবেশ করানো তার দায়িত্ব ছিল।
 (ঘ) তার চেয়ে যথেষ্ট সিনিয়র হিসাবে আমার প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটির জন্য আমার নিকট ক্ষমা চাওয়া তাঁর কর্তব্য ছিল।  
 
 এ চারটি ব্যাপারে উক্ত গার্ডের আচরণ আমার নিকট অত্যন্ত প্রশংসনীয় হিসেবে মনে হল। গ্রাহকসহ সবার প্রতি গেটম্যানের এমন আচরণ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূতি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারে।
 
২. গ্রাহকের অনুভূতির মূল্যায়ণঃ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তির বিশেষ অনুভূতি বা আবেগ থাকতে পারে। এই অনুভূতিটুকু উপলব্ধি এবং তা মূল্যায়ণের দিকে পণ্য ও সেবা পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
 
উদাহরণঃ আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ অনেক নির্বাহী অফিসার ও স্টাফদের নিকট থেকে প্রায়ই শুনতে পাই যে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার দিন একজন বয়স্ক ব্যক্তি লোকাল অফিসের মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ আরম্ভ করে দেন। এই নামাজ ছিল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়া উপলক্ষ্যে শোকরানা নামাজ। মেইন গেটে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার কারণে লোকজনের চলাচল বিঘ্নতা ঘটছিল বিধায় অনেকেই ক্ষেপে যান। কিন্তু এই নামায ছিল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়া উপলক্ষে তাঁর আবেগ এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। তাই যাঁরা তা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন তাঁরা বিক্ষুব্ধ লোকদের জন্য বাঁধ সাধেন এবং বিষয়টি শান্তভাবে বুঝিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। এমন উপলব্ধি শুধু বাছাই করা লোকদের পক্ষেই সম্ভব।
 
এই বিষয়টি স্মৃতিচারণ করার সময়ে আমার একটা বিষয় বিশেষভাবে মনে পড়ে। তা হচ্ছে এই যে, নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে William Wordsworth- এর একটা কবিতার যে সারমর্ম আমাদের নোট বইতে ছিল তা আমার মনঃপুত না হওয়াতে সুন্দর একটা সারমর্ম লিখে দেয়ার জন্য আমাদের শিক্ষককে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলে তিনি সুন্দর ভাষায় তা লিখে দেন। এর সর্বশেষ বাক্যটি ছিল-
''Human Beauties are unnoticed because of the lack of the imaginative power of the common man''
স্থূলতা আর সূক্ষ্মতা সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। একটা জিনিস সাধারণ ভাবে বুঝা আর সূক্ষ্মভাবে বুঝা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। অনেক সাধারণ মানুষ এই মর্মে মন্তব্য করেন যে, ব্যাংক এবং যে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিম্নস্তরের কর্মীরা প্রচুর পরিশ্রম করেন  অথচ সামান্য বেতন নেন। অথচ ম্যানেজার এবং উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ কয়েকটা স্বাক্ষর করা আর টেলিফোনে কিছু খোশ-গল্পের  বিনিময়ে প্রচুর অংকের বেতন নেন। একজন সাধারণ শ্রমিক মাথায় করে পাঁচতলায় বোঝাতুলে সামান্য পারিশ্রমিক নেন  কিন্তু একজন প্রেসিডেন্ট শুধু সই করেই  প্রচুর টাকা বেতন নেন। এই ধারণাগুলো হচ্ছে উপলব্ধি করার যোগ্যতার (Imaginative Power) অভাব। উপলদ্ধি করার যোগ্যতা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করার জন্যই তো দর্শন শাস্ত্রের উৎপত্তি। একজন দার্শনিকের এত মর্যাদার অন্তর্নিহিত কারণ কি?  গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসকে গোটা বিশ্ব কেন এত মর্যাদার সাথে স্মরণ করে? সক্রেটিসের তিরোধানের ২৫০০ বৎসর পরও জ্ঞানী মানুষের মনে কেন ঐ Bellis এর রচিত নিম্মোক্ত অনুচ্ছেদটি কেন বার বার দোলা দেয়?
''The Athenians too soon repented of their deed. They could not bring their wisest philosopher back to life. But they put to death one of his accusers and banished the other two from the city. Then they raised a statue to the memory of the man they had killed so recently condemned to death''
আমি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড মিরপুর শাখায় কর্মরত থাকাকালীন কোন এক দিন এক ব্যক্তি এসে বললেন স্যার, আঙ্গুলের মধ্যে বানর কামড় দিয়েছে, খুব ব্যথা তাই সই করতে পারি না কিন্তু হিসাব খোলা খুব জরুরী। আমি জানতে চাইলাম যে, কোত্থেকে কিভাবে বানর কামড় দিয়েছে। জবাবে তিনি বলেন স্যার, আমি চিড়িয়াখানায় চাকরী করি, একটা বানর খাঁচা ভেঙ্গে পালাচ্ছিল, আমি ওটাকে ধরতে গেছি পরে সেটা আমার আঙ্গুলে কামড় দিয়েছে। আমার বেতনের টাকা কালেকশান আর সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় করার জন্য হিসাব খোলা খুবই জরুরী। দয়া করে একটা হিসাব খুলে দেন। হিসাব খোলার দায়িত্বপ্রাপ্ত  আমার জুনিয়র সহকর্মী ভাই আমাকে বলেন, "স্যার! এই লোকটা আঙ্গুলে ব্যাথার কারণে সই করতে পারেন না, কিন্তু হিসাব খুলে দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে পীড়াপীড়ি করছেন। হাতের ব্যথা ভাল হওয়ার পর হিসাব খুলতে বললাম, কিন্তু উনি নাছোড় বান্দার মত আমাকে পীড়াপীড়ি করছেন।" যাহোক, গ্রাহকের অনুভূতির কথা বিবেচনা করে আমি তাকে টিপসই দ্বারা একটা হিসাব খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তাকে বললাম যে, হাতের ব্যথা ভাল হওয়ার পর টিপ সইয়ের বদলে নুতন সই রেকর্ড ভুক্ত করে হিসাব পরিচালনা করতে হবে। গ্রাহক আমার কথায় সায় দিলেন এবং পরবর্তীতে তার প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করলেন।
 
ব্যাংকিং করতে গিয়ে আরো অনেক বিষয়ের সাথে আমাদের সাক্ষাত ঘটে যেখানে গ্রাহকের অনুভূতিকে বিশেষভাবে মূল্যায়ণ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই নবজাতক সমভ্যিব্যহারে জনক-জননীর ব্যাংকে উপস্থিতি আমাদের নজর কেড়ে নেয়। কল্পনার রাজ্যে একটু স্থান করে দেখুন তো “মাতৃজঠরে আশ্রিত শিশুকে ঘিরে আত্মীয় পরিজনদের কতইনা উৎসাহ; আশা নিরাশার সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শিশু একদিন ভূমিষ্ঠ হয়। “নিজের নাড়ীছেঁড়া সন্তানকে ঘিরে মমতাময়ী মাতৃত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত মানুষটির সাথে সাথে স্নেহবাৎসল্যে ভরপুর পিতৃমহোদযয়ের মানসপটে রঙিন রঙিন স্বপ্ন বাসা বাঁধে। একটা সঞ্চয় অভ্যাস নবাগত সন্তানের অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনে সাফল্যের স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে এই ভরসায় তাঁদের মনে সঞ্চয়ের ব্রত জন্মায়। এরই অভিব্যক্তির জের হচ্ছে নবাগত সন্তান সমভ্যিব্যহারেহারে জনক-জননীর ব্যাংকে আগমণ। এক্ষেত্রে হিসাব খোলার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব থাকলে অত্যন্ত যত্নসহকারে মূল্যবান পরামর্শ দানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে নিতে হয়। (অসম্পূর্ণ)
-----------------------------------------

উৎসর্গ
পণ্য ও সেবা পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিকট থেকে উপযুক্ত মর্যাদা প্রত্যাশী অগণিত গ্রাহকদের প্রতি নিবেদিত

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !